এমন কথা কি শুনেছেন- ছেলের নামে ঝাউগাছের নাম! অথবা মেয়ের বিদেশ যাওয়ার দিন স্মরণীয় করে রাখার জন্য গাছের চারা রোপণ। এবং সেই গাছটি বড় হওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে করা- গাছটি বড় হচ্ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে মেয়ে।

কখনও কি শুনেছেন- আনন্দ কিংবা দুঃখের বিষাদ ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য বাগানের গাছ জড়িয়ে হেসে-কেঁদে গল্প বলার কথা? ঠিক এই কাজটিই করেন লেখক ও সংগীতশিল্পী মনিকা চক্রবর্তী।

মনিকা মাতৃত্ব উপভোগ করেন প্রতি মুহূর্তে। সংসারে তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেটি স্পেশাল চাইল্ড। এ নিয়ে মায়ের মানসিক দৈন্য নেই। গর্বের সঙ্গে মনিকা বলেন, মা-ছেলের সম্পর্ক শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর মোহ-মায়া ছাপিয়ে হৃদয়ে রোপিত যা বেড়ে ওঠে লতার মতো জড়িয়ে।

ছেলে সায়ন্তর বয়স ২৫। আর দশজনের মতো স্বাভাবিক হলে সেও পৃথিবীর জঞ্জালে পুরোপুরি জড়িয়ে যেত। কিন্তু তার পৃথিবী এখনও শিশুসুলভ। তাই মা মানিকা চক্রবর্তীও ‘শিশুমা’। যে মায়ের ভাষা ছোটদের ভাষায় জড়িয়ে কথা বলে। সায়ন্তর জন্মের ১৩ বছর পর্যন্ত মনিকা চক্রবর্তী সমাজ, আত্মীয়-স্বজন এড়িয়ে চলেছেন। স্পেশাল শিশুকে কেন্দ্র করে সমাজে প্রচলিত ট্যাবু তাকে আঘাত করেছে। তিনি নিজেকে খুঁজে নিয়েছেন মেয়ে মিথিলা চক্রবর্তীর বন্ধুত্বে। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য মিথিলা আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন।

মনিকা চক্রবর্তীর দিন-মান ভাগ হয়ে গেছে সংগীত, সাহিত্য, সন্তান এবং গাছের সঙ্গে। জীবনসঙ্গী হিসেবেও পেয়েছেন একজন সৃজনশীল মানুষকে। ভালোবেসে সংসার পেতেছেন কবি কুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে।

 

মনিকা চক্রবর্তীর ছাদ বাগান রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায়, মধুমতি টাওয়ারে। এটি পনেরো তলা ভবন। সেখানে অনেক পরিবারের বসবাস, অখণ্ড ছাদ, ছাদ বাগান গড়ে তোলা একেবারে চাট্টিখানি কথা নয়! আলোচনা, সমালোচার মুখে পড়তে হয়েছে। নিজের টাকায় ছাদে বেড তৈরি করে টবে গাছ লাগিয়েছেন। ফুলে ফুলে ভরা বাগানটি এখন ভবনের শিশুদের কাছে প্রিয় খেলায় জায়গা হয়ে উঠেছে। বলতে গেলে শিশুরাই বাগানটি ভালোবেসেছে অকৃত্রিমভাবে। এতে অভিভাবকদের সমালোচনা কমেছে। বাগান কেন্দ্র করে ‘ভাব’ জমেছে এক পরিবারের সঙ্গে অন্য পরিবারের। এই ছাদবাগানেই সন্ধ্যায় জমে ওঠে চায়ের আড্ডা কিংবা কারও জন্মদিনের অনুষ্ঠান।

হাজারি গোলাপ, জুঁই, সিলভিয়া, কসমস, অলকানন্দাসহ অনেক রকম ফুলের চাষ করেন মনিকা চক্রবর্তী। তিনি বলেন, বাজার থেকে তো চাইলেই ফল কিনে আনতে পারি, তাছাড়া অন্যরা যাতে মনে না করেন যে, আমি লাভের আশায় বাগান করেছি সেজন্য ফুলের চাষ বেশি করি। ফুলের পাশাপাশি বাগানে রয়েছে মরিচ, শিম, লেবু, পেঁপে। এসব প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন এই ছাদ কৃষক। চলতি শীতে প্রতিবেশীদের কাছে বিশেষ সমাদর পেয়েছে তুলশি পাতা- জানালেন মনিকা চক্রবর্তীর এক প্রতিবেশী। 

বিকেলের সোনামাখা রোদে ছাদবাগানে দারুণ আড্ডা হলো মনিকা চক্রবর্তীর সঙ্গে। শুধু কি বাগান, এই বাগানের মাথার ওপর দিয়ে ডানা মেলে বারবার উড়ে যাওয়া, উড়তে থাকা চিলের দৃশ্যও যুক্ত হয়ে থাকলো এই আড্ডার স্মৃতিতে। মনিকা চক্রবর্তী বলেন, শহুরে জটিল জীবনে অনেকেই একাকীত্বের যন্ত্রণায় আত্মঘাতি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অথচ তারা যদি বাগান করে খুঁজে পায় ভালোবাসা দেয়া-নেয়ার উপলক্ষ্য; ছাদে না হোক, বারান্দায়ও যদি একটি বাগান করে গাছের পরিচর্যা করে, ভালোবাসে তাহলে গাছেরাও তাদের দ্বিগুণ ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে পারে। তাছাড়া যে মানুষটি মনে করছে তাকে কেউ ভালোবাসে না, তার উচিত নিজেকে ভালোবাসা। যা কিছু সুন্দর সেগুলোকে ভালোবাসা। বাগানের প্রতি ভালোবাসা নিজেকে ভালোবাসার মতোই।